একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান এক অবিস্মরণীয় নাম। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল ২৫ মার্চ রাতেই। আর ওই ২৫ মার্চ গত মধ্যরাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন মেজর জিয়া। তখন তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড। তিনি শুধু বিদ্রোহ ঘোষণাই করেননি, ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘোষণাটিও পাঠ করেছিলেন। সেদিন সমগ্র বাঙালি জাতি ছিল দিশেহারা, দিকনির্দেশনাহীন। ঠিক এ সময়ে মেজর জিয়ার প্রত্যয়দীপ্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠের ঘোষণা দেশবাসী সুস্পষ্টভাবে শুনেছেন। এ ঘোষণায় তাদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, আশার সঞ্চার হয়েছে, চিত্ত শিহরিত হয়েছে এবং জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়েছে। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসা কণ্ঠটি ছিল—আমি মেজর জিয়া বলছি…। এ সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার বলেন, ‘জিয়ার ২৭ মার্চের ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে যে একটা প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়।’ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করার পর বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে মেজর জিয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
একাত্তরের ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। প্রথম ঘোষণায় তিনি নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন। পরে সংশোধন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে আবারও ঘোষণাটি দেন। এ ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ ভারতের ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের দলিলেও এটি রয়েছে। সে ঘোষণাটি ছিল, ‘আমি মেজর জিয়া বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান সেনাপতি হিসেবে এতদ্বারা আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরও ঘোষণা করছি যে, আমরা ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর অধীনে একটি স্বাধীন বৈধ সরকার গঠন করেছি। এই সরকার আইনগতভাবে এবং সংবিধান অনুসারে পরিচালিত হবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। নতুন গণতান্ত্রিক সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ সরকার সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রয়াসী এবং আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য কাজ করে যাবে। আমি বাংলাদেশে পরিচালিত বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশে জনমত সংগঠিত করার জন্য সবার প্রতি আবেদন জানাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌম বৈধ সরকার এবং এ সরকার বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য।’
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মির্জার কথোপকথন নিয়ে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’ শীর্ষক বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণার ঐতিহাসিক তথ্যটি স্থান পেয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ কে খন্দকার ছিলেন মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান সেনাপতি, বর্তমানে তিনি সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এবং সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সভাপতি। মঈদুল হাসান ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও মূলধারা ’৭১ গ্রন্থের লেখক এবং এস আর মির্জা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গঠিত যুবশিবিরের মহাপরিচালক।
তিন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথোপকথনে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টিও বিস্তারিতভাবে স্থান পেয়েছে। এ কে খোন্দকার বলেন, ‘রেডিও কর্মীদের প্রচেষ্টায় ২৬ মার্চ দুপুর ২টার সময় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। অবশ্য মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথমেই যে ঘোষণাটি দেন, সেটি ভুলভাবে দেন। সেই ঘোষণায় তিনি নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। ২৬ মার্চ দুপুরে স্বাধীনতার ঘোষণা এমএ হান্নান সাহেব যেটা পড়েছিলেন এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার দিকে মেজর জিয়া যেটা পড়েন, তার মধ্যে কিন্তু একটা পার্থক্য ছিল। ২৬ মার্চেরটা অনেকে শুনতে পাননি। অন্যদিকে যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি মেজরের কথা শোনা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। আমি নিজে জানি, যুদ্ধের সময় জানি, যুদ্ধের পরবর্তী সময়ও জানি যে, মেজর জিয়ার এ ঘোষণাটি পড়ার ফলে সারাদেশের ভেতরে এবং সীমান্তে যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল—হ্যাঁ, এবার বাংলাদেশ একটা যুদ্ধে নামলো। জিয়ার ২৭ মার্চ ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যারা ছিল, তাদের মধ্যে যে একটা প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়।
\
মঈদুল হাসান বলেন, অন্যের কথা কী বলব, মেজর জিয়ার বেতার ঘোষণা শুনে আমি নিজে মনে করেছিলাম যে—না, সত্যি তাহলে সামরিক বাহিনীর বিপুল সংখ্যক লোক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। এটা আমার মনে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং আমি উত্সাহিত বোধ করি। আমি আশপাশে যাদের চিনতাম, তারাও এই ঘোষণায় উত্সাহিত হন। সুতরাং জিয়ার সেই সময়টুকুর সেই অবদান খাটো করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
এস আর মির্জা বলেন, ২৫ মার্চের পর আমি সব সময় রেডিও সঙ্গে রেখেছিলাম। এম এ হান্নান সাহেবের ঘোষণাটি আমি শুনিনি। ২৭ মার্চ বিকালে পরিষ্কার শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। এই ঘোষণা শুনে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এই ভেবে যে—হ্যাঁ, এখন মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কারণ, তাদের সঙ্গে বাঙালি সেনারাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে।
চট্টগ্রামে মেজর জিয়া যেভাবে বিদ্রোহ করলেন : একাত্তরের ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যরাতে চট্টগ্রামে বিদ্রোহ ঘোষণার সেই ঐতিহাসিক ঘটনা জিয়াউর রহমান নিজেই লিখে গেছেন তার অবিস্মরণীয় লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ শীর্ষক নিবন্ধে। এটি দৈনিক বাংলায় ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। জিয়াউর রহমান সেই ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে—১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে আমাকে নিয়োগ করা হলো চট্টগ্রামে। এবার ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়নের সেকন্ড ইন-কমান্ড। এর কয়েক দিন পর আমাকে ঢাকা যেতে হয়। নির্বাচনের সময়টায় আমি ছিলাম ক্যান্টনমেন্টে। প্রথম থেকেই পাকিস্তানি অফিসাররা মনে করতো চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই হবে। কিন্তু নির্বাচনের দ্বিতীয় দিনেই তাদের মুখে আমি দেখলাম হতাশার সুস্পষ্ট ছাপ। ঢাকায় অবস্থানকারী পাকিস্তানি সিনিয়র অফিসারদের মুখে দেখলাম আমি আতঙ্কের ছবি। তাদের এ আতঙ্কের কারণও আমার অজানা ছিল না। শিগগিরই জনগণ গণতন্ত্র ফিরে পাবে এ আশায় আমরা বাঙলি অফিসাররা তখন আনন্দে উত্ফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম।
চট্টগ্রামে আমরা ব্যস্ত ছিলাম অষ্টম ব্যাটালিয়নকে গড়ে তোলার কাজে। এটা ছিল রেজিমেন্টের তরুণতম ব্যাটালিয়ন। এটার ঘাঁটি ছিল ষোলশহর বাজারে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে এই ব্যাটালিয়নকে পাকিস্তানের খারিয়ানে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এর জন্য আমাদের সেখানে পাঠাতে হয়েছিল দুইশ’ জওয়ানের এক অগ্রগামী দল। অন্যরা ছিল একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের সৈনিক। আমাদের তখন যেসব অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে ছিল তিনশ’ পুরনো ৩০৩ রাইফেল, চারটা এলএমজি ও দুটি তিন ইঞ্চি মর্টার। গোলাবারুদের পরিমাণও ছিল নগণ্য। আমাদের অ্যান্টিট্যাংক বা ভারী মেশিনগান ছিল না।
ফেব্রুয়ারির শেষদিকে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠিছিল, তখন আমি একদিন খবর পেলাম, তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিহারিদের বাড়িতে বাস করতে শুরু করেছে। খবর নিয়ে আমি আরও জানালাম, কমান্ডোরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে বিহারি বাড়িগুলোয় জমা করেছে এবং রাতের অন্ধকারে বিপুল সংখ্যায় তরুণ বিহারি সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে। এসব কিছু থেকে এরা যে ভয়ানক রকমের অশুভ কিছু করবে তার সুস্পষ্ট আভাসই আমরা পেলাম।
এরপর এলো ১ মার্চ। সারাদেশে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন। এর পরদিন দাঙ্গা হলো। বিহারিরা হামলা করেছিল এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে। এর থেকে আরও গোলযোগের সূচনা হলো।
এ সময়ে ব্যাটালিয়নের নিরাপত্তা এনসিওরা আমাকে জানালো প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিংশতিতম বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা বেসামরিক পোশাক পরে বেসামরিক ট্রাকে করে কোথায় যেন যায়। তারা ফিরে আসে আবার শেষ রাতের দিকে। আমি উত্সুক হলাম। লোক লাগালাম খবর নিতে। খবর নিয়ে জানলাম প্রতিরাতেই তারা যায় কতগুলো নির্দিষ্ট বাঙালি পাড়ায়। নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে বাঙালিদের। এ সময়ে প্রতিদিনই ছুরিকাহত বাঙালিদের হাসপাতালে ভর্তি হতেও শোনা যায়।
এ সময়ে আমাদের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানজুয়া আমার গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখার জন্যও লোক লাগায়। মাঝে মাঝেই তার লোকেরা এসে আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। আমরা তখন আশঙ্কা করছিলাম, আমাদের হয়তো নিরস্ত্র করা হবে। আমি আমার মনোভাব দমন করে কাজ করে যাই এবং নিরস্ত্র করার উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়ার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করি। বাঙালি হত্যা ও বাঙালি দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ক্রমেই বাড়তে থাকে।
আমাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করা হলে আমি কী ব্যবস্থা গ্রহণ করব, কর্নেল (তখন মেজর) শওকতও আমার কাছে তা জানতে চান। ক্যাপ্টেন শমসের মবিন এবং মেজর খালেকুজ্জামান আমাকে জানান যে স্বাধীনতার জন্য আমি যদি অস্ত্র তুলে নেই তাহলে তারাও দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না। ক্যাপ্টেন অলি আহমদ আমাদের মাঝে খবর আদান-প্রদান করতেন। জেসিও এবং এনসিওরাও দলে দলে বিভক্ত হয়ে আমার কাছে আসতে থাকে। তারা আমাকে জানায় যে কিছু একটা না করলে বাঙালি জাতি চিরদিনের জন্য দাসে পরিণত হবে। আমি নীরবে তাদের কথা শুনতাম। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম উপযুক্ত সময় এলেই মুখ খুলব। বস্তুত ৪ মার্চ আমি ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে ডেকে নেই। আমাদের ছিল সেটা প্রথম বৈঠক। আমি তাকে সোজাসুজি বললাম, সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। ক্যাপ্টেন আহমদও আমার সঙ্গে একমত হন। আমরা পরিকল্পনা তৈরি করি এবং প্রতিদিনই আলোচনা বৈঠকে মিলিত হতে শুরু করি।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পাকিস্তানি সৈনিকদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল।
১৩ মার্চ শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার আলোচনা। আমরা সবাই ক্ষণিকের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমরা আশা করলাম, পাকিস্তানি নেতারা যুক্তি মানবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানিদের সামরিক প্রস্তুতি হ্রাস না পেয়ে দিন দিনই বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। প্রতিদিনই পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানি করা হলো। বিভিন্ন স্থানে জমা হতে থাকল অস্ত্রশস্ত্র তথা গোলাবারুদ। সিনিয়র পাকিস্তানি সামরিক অফিসাররা সন্দেহজনকভাবে বিভিন্ন গ্যারিসনে আসা-যাওয়া শুরু করল। চট্টগ্রামে নৌবাহিনীরও শক্তি বৃদ্ধি করা হলো।
১৭ মার্চ স্টেডিয়ামে ইবিআরসির লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমআর চৌধুরী, আমি, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ ও মেজর আমিন চৌধুরী এক গোপন বৈঠকে মিলিত হলাম। এক চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। লে. কর্নেল চৌধুরীকে অনুরোধ করলাম নেতৃত্ব দিতে।
দুই দিন পর ইপিআরের ক্যাপ্টেন (এখন মেজর) রফিক আমার বাসায় গেলেন এবং ইপিআর বাহিনীকে সঙ্গে নেয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমরা ইপিআর বাহিনীকেও আমাদের পরিকল্পনাভুক্ত করলাম। এরই মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী সামরিক তত্পরতা শুরু করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করল।
২১ মার্চ জেনারেল আবদুল হামিদ গেলেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। চট্টগ্রামে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ তার এই সফরের উদ্দেশ্য। সেদিন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে ভোজসভায় জেনারেল হামিদ ২০তম বালু রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাতমীকে বলল—‘ফাতমী, সংক্ষেপে, ক্ষিপ্রগতিতে যত কম সম্ভব লোক ক্ষয় করে কাজ সারতে হবে। আমি এই কথাগুলো শুনেছিলাম।
২৪ মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ঢাকা চলে গেলেন। সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনী শক্তি প্রয়োগে চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথে জাহাজ সোয়াত থেকে অস্ত্র নামানোর জন্যই বন্দরের দিকে ছিল তাদের এ অভিযান।
পথে জনতার সঙ্গে ঘটল তাদের কয়েকদফা সংঘর্ষ। এতে নিহত হলো বিপুলসংখ্যক বাঙালি। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সশস্ত্র সংগ্রাম যে কোনো মুহূর্তে শুরু হতে পারে, আমরা তা ধরেই নিয়েছিলাম। মানসিক দিক দিয়ে আমরা ছিলাম প্রস্তুত। পরদিন আমরা পথের ব্যারিকেড অপসারণের কাজে ব্যস্ত ছিলাম।
তারপর এলো সেই কাল রাত। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী কাল রাত। রাত ১১টায় আমার কমান্ডিং অফিসার আমাকে নির্দেশ দিলেন নৌবাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে জেনারেল আনসারীর কাছে রিপোর্ট করতে। আমার সঙ্গে নৌবাহিনীর (পাকিস্তানি) প্রহরী থাকবে তাও জানানো হলো। আমি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে আমার তিনজন লোক নিয়ে যেতে পারি। তবে আমার সঙ্গে আমারই ব্যাটালিয়নের একজন পাকিস্তানি অফিসারও থাকবে। অবশ্য কমান্ডিং অফিসারের মতে, সে যাবে আমাকে গার্ড দিতেই।
এ আদেশ পালন করা আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব। আমি বন্দরে যাচ্ছি কিনা তা দেখার জন্য একজন লোকও ছিল। আর বন্দরে স্বয়ং প্রতীক্ষায় ছিল জেনারেল আনসারী। হয়তো বা আমাকে চিরকালের মতোই স্বাগত জানাতে।
আমরা বন্দরের পথে বেরুলাম। আগ্রাবাদে আমাদের থামতে হলো। পথে ছিল ব্যারিকেড। এ সময়ে সেখানে এলো মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী। ক্যাপ্টেন অলি আহমদের কাছ থেকে এক বার্তা নিয়ে এসেছে। আমি রাস্তায় হাঁটছিলাম। খালেক আমাকে একটু দূরে নিয়ে গেল। কানে কানে বলল, তারা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তত্পরতা শুরু করেছে। বহু বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে।
এটা ছিল একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত সময়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি বললাম, ‘উই রিভোল্ট’—আমরা বিদ্রোহ করলাম। তুমি ষোলশহর বাজারে যাও। পাকিস্তানি অফিসারদের গ্রেফতার করো। অলি আহমদকে বল ব্যাটালিয়ন তৈরি রাখতে। আমি আসছি। আমি নৌবাহিনীর ট্রাকের কাছে ফিরে গেলাম। পাকিস্তানি অফিসার সেনাবাহিনীর চিফ পেটি অফিসার ও ড্রাইভারকে জানালাম যে, আমাদের আর বন্দরে যাওয়ার দরকার নেই। এতে তাদের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না দেখে আমি পাঞ্জাবি ড্রাইভারকে ট্রাক ঘোরাতে বললাম। ভাগ্য ভালো ড্রাইভার আমার আদেশ মানল। আমরা আবার ফিরে চললাম। ষোলশহর বাজারে পৌঁছেই আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে একটা রাইফেল তুলে নিলাম। পাকিস্তানি অফিসারের দিকে। তাক করে বললাম ‘হাত তোলো, আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম। নৌবাহিনীর লোকেরা এতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। পর মুহূর্তেই আমি নৌবাহিনীর অফিসারের দিকে রাইফেল তাক করলাম। তারা ছিল আটজন। সবাই আমার নির্দেশ মানল এবং অস্ত্র ফেলে দিল।
আমি কমান্ডিং অফিসারের জিপ নিয়ে তার বাসার দিকে রওনা দিলাম। তার বাসায় পৌঁছে হাত রাখলাম কলিং বেলে। কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া পাজামা পরেই বেরিয়ে এলো। খুলে দিল দরজা। ক্ষিপ্রগতিতে আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম এবং গলাশুদ্ধ তার কলার টেনে ধরলাম। দ্রুতগতিতে আবার দরজা খুলে কর্নেল জানজুয়াকে আমি বাইরে টেনে আনলাম। বললাম, বন্দরে পাঠিয়ে আমাকে মারতে চেয়েছিলে? এই আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম। এখন লক্ষ্মী সোনার মতো আমার সঙ্গে এসো। সে আমার কথা মানল। আমি তাকে ব্যাটালিয়নে নিয়ে এলাম। অফিসারদের মেসে যাওয়ার পথে আমি কর্নেল শওকতকে (তখন মেজর) ডাকলাম। তাকে জানালাম আমরা বিদ্রোহ করেছি। শওকত আমার হাতে হাত মেলাল।
ব্যাটালিয়নে ফিরে দেখলাম সব পাকিস্তানি অফিসারকে বন্দি করে একটা ঘরে রাখা হয়েছে। আমি অফিসে গেলাম। চেষ্টা করলাম লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমআর চৌধুরীর সঙ্গে আর মেজর রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু পারলাম না। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তারপর রিং করলাম বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরকে। তাকে অনুরোধ জানালাম ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, কমিশনার, ডিআইজি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা।
এদের সবার সঙ্গেই আমি টেলিফোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাউকেই পাইনি। তাই টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমেই আমি তাদের খবর দিতে চেয়েছিলাম। অপারেটর সানন্দে আমার অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হলো।
সময় ছিল অতি মূল্যবান। আমি ব্যাটালিয়নের অফিসার, জেসিও আর জওয়ানদের ডাকলাম। তাদের উদ্দেশে একটি ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলাম। তারা সবই জানত। আমি সংক্ষেপে সব বললাম এবং তাদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা জানিয়ে নির্দেশ দিলাম স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। তারা সর্বসম্মতিক্রমে হৃষ্টচিত্তে এ আদেশ মেনে নিল। আমি তাদের একটা সামরিক পরিকল্পনা দিলাম।
তখন রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট। ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সাল। রক্ত আখরে বাঙালির হৃদয়ে লেখা একটা দিন। বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন স্মরণ রাখবে এই দিনটিকে। স্মরণ রাখবে, ভালোবাসবে। এই দিনটিকে তারা কোনো দিন ভুলবে না। কো-ন-দি-ন না।
জিয়ার বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠের পর সংগঠিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মেজর জিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স’ গঠিত হয় ৭ জুলাই। মেজর জিয়ার নামানুসারে জেড ফোর্স বা জিয়া ফোর্স রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ‘জেড ফোর্স’ বিশেষ অবদান রাখে। এই ফোর্সে তিনটি নিয়মিত পদাতিক বাহিনী ছিল। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল। ব্যাটালিয়ন ব্রিগেড কমান্ড করেন জিয়া। ব্রিগেড মেজরের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন অলি। মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্স কামালপুর, বাহাদুরাবাদ ঘাট, দেওয়ানগঞ্জ খাল, রৌমারী, চিলমারী, হাজপাড়া, ছোটখাল, সিলেটের গোয়াইনঘাট, টেংরাটিলা, গোবিন্দগঞ্জ, সালুটিকর বিমানবন্দর, ধলাই চা-বাগান, জকিগঞ্জ, আলী ময়দান, ভানুগাছ, সিলেট এমসি কলেজ, কানাইঘাট, রামপুর, ফুলতলা চা-বাগান, বড়লেখা সেতু, লতু, সাগরনাথ চা-বাগান ইত্যাদি এলাকায় বীরত্বের সঙ্গে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে। স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ভাষণে মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের যুদ্ধকে স্টালিনগ্রাডের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে একে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ভাষণে তিনি বলেছিলেন—‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলার ভাইবোনেরা যে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে।’ (সূত্র : বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, এইচটি ইমাম)। বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের জন্য সেক্টর কমান্ডার জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াকে বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।