অলিউল্লাহ নোমান : লন্ডনে নতুন আলোচনা এখন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। বিএনপি, আওয়ামী লীগ সবার মাঝে নতুন আলোচনায় বিষয় এটি। এমনকি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন ব্যক্তিরাও এই আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। এই আলোচনা এবং বিতর্কে জড়িয়েছেন বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতানেত্রীরাও। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন জবরদস্তির নির্বাচনে গঠিত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা এবং ১৯ দলীয় জোট প্রধান বেগম খালেদা জিয়া এখন এই বিতর্কের অংশ। যার যার অবস্থান থেকে দুই নেত্রী বক্তব্য দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হানিফ বিতর্কটির সূত্রপাতকারী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন।
যে জায়গায় যাই, যার সঙ্গেই দেখা হয় প্রশ্ন একটাই প্রশ্ন—বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি কে ছিলেন। বিএনপির রাজনীতি করেন এমন অনেকেও প্রশ্ন করেন বিষয়টি নিয়ে। তাদের প্রশ্নের ধরন দেখে মনে হয় অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীদেরও। তাদের কাছে আমি পাল্টা একটি প্রশ্ন রাখি। প্রবাসী সরকার গঠন হয়েছিল ১০ এপ্রিল। মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠান হয় ১৭ এপ্রিল। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৪টি দিন রাষ্ট্রপতি আসলে কে ছিলেন! স্বাধীনতা ঘোষণার পর একটি দেশ রাষ্ট্রপতিবিহীন থাকতে পারে না। তখন কারো কাছে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।
আমি আসলে মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানার আগ্রহ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট জানারও চেষ্টা করি। নিজের মধ্যেও নানা প্রশ্ন জাগে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপট নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি। ২৫ মার্চ রাতে তত্কালীন ইয়াহিয়া সরকারের অনুগত সামরিক বাহিনী আক্রমণ করেছিল। সেদিন আক্রমণ না করে যদি শেখ মুজিবকে রাত ১২টায় জানানো হতো দাবি মেনে নেয়া হলো। ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে বার্তা আসল শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। তাহলে চিত্রটা কেমন হতো! তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতো!
শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার না হয়ে যদি সেদিন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতেন তাহলে, কি আজকের বাংলাদেশ আমরা পেতাম! পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত তত্কালীন মেজর জিয়াউর রহমান যদি ‘উই রিভোল্ট’ বলে নিজের ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করতেন, তাদের গ্রেফতার না করে যদি জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতি শপথে অনড় থাকতেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যদি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিতেন তাহলে কি দাঁড়াতো! এই প্রশ্নগুলো আমার সামনে বার বার জাগে।
ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান দু’বার স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। জিয়াউর রহমানের প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণাটি এখনো জীবন্ত রয়েছে। তিনি নিজেকে হেড অব দি স্টেট হিসাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর আবার আরেকটি ঘোষণা দেন। যেখানে বলা হয় অন বিহাফ অব গ্রেট ন্যাশনাল লিডার শেখ মুজিবুর রহমান। দ্বিতীয়বারের ঘোষণায় কিন্তু বলা হয়নি হেড অব দি স্ট্যাট শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে। বলা হয়েছে গ্রেট ন্যাশনাল লিডার শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে। জিয়াউর রহমান নিজেকে হেড অব দি স্টেট বলে ঘোষিত প্রথম ঘোষণাটি কিন্তু প্রত্যাহার করা হয়নি। ইতিহাসের একটি কঠিন মুহূর্তের এই জায়গাটুকু ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
গত ২৫ মার্চ লন্ডনের ম্যানরপার্কে রিজেন্সি অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। এই আলোচনা সভায় তারেক রহমান প্রথম রাষ্ট্রপতির প্রসঙ্গটি নিয়ে বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যে ইতিহাসের অনুসন্ধান ছিল। তিনি সেদিন রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপট এবং তত্কালীন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন। বিশেষ করে দৈনিক ইত্তেফাকের কিছু সংবাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। ইত্তেফাক তখনো আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ইত্তেফাকের অবস্থান ছিল স্পষ্ট। বর্তমানেও ইত্তেফাকের মালিক এবং সম্পাদক আনোয়ার হোসন মঞ্জু আওয়ামী লীগের পক্ষে। শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
ইত্তেফাকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, ২৬ মার্চ এবং ২৭ মার্চ প্রকাশিত সংবাদ শিরোনামগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন তারেক রহমান। এসব সংবাদ শিরোনাম এবং সংবাদগুলোতে প্রকাশিত তথ্য শেখ মুজিবুর রহমান তত্কালীন শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা এবং আপসের চেষ্টার বিষয়গুলো স্পষ্ট করে। আওয়ামী লীগ দাবি করে ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তারেক রহমানের বক্তব্যে প্রশ্ন রাখা হয়েছে, ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলে এই আপসের চেষ্টা কেন। ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করে থাকলে তত্কালীন ইয়াহিয়া সরকারের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেন কোন যুক্তিতে। তারেক রমানের যুক্তি হচ্ছে ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে থাকলে ৮ মার্চ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হওয়ার কথা। নতুবা যুদ্ধ শুরু হবে। এই দুইটার কোনটাই হলো না। বরং শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখা গেল তত্কালীন সামরিক সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করছেন এবং সিরিজ আলোচনা চালিয়ে গেছেন।
আমরা আশা করেছিলাম তারেক রহমানের এই বক্তব্যের জবাব দেয়া হবে দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে। বুধবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তারেক রহমান যেভাবে তথ্য প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন শেখ হাসিনা সেটার ধারে কাছেও নেই। পুরনো সেই চর্বিত চর্বনই দেখা যায় শেখ হাসিনার বক্তব্যে। শেখ হাসিনা বললেন, ‘কিছু অর্বাচিন ইতিহাস বিকৃত করছে’। তারেক রহমানকে ইঙ্গিত করেই তিনি ‘অর্বাচিন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী ধরে নিলাম তারেক রহমান ইতিহাস বিকৃত করে বক্তব্য রেখেছেন। কারণ তারেক রহমান তখন ছোট শিশু ছিলেন। মায়ের সঙ্গে বন্দি ছিলেন। তত্কালীন গণমাধ্যমই হবে তার ইতিহাস জানার মূল সূত্র।
শেখ হাসিনাও তখন পাকিস্তান বাহিনীর পাহারায় মায়ের সঙ্গে নিরাপদে ছিলেন। তবে বয়সে অনেক বড় ছিলেন। তারেক রহমানের মাতৃতুল্য বয়স হলো শেখ হাসিনার। একটি দলের সভানেত্রীর কাছ থেকে তারেক রহমানের দালিলিক প্রমাণের বিপরীতে দালিলিক প্রমাণ দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। তারেক রহমান ইতিহাস বিকৃত করে বক্তব্য দিয়ে থাকলে সঠিক তথ্য দেখার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। কিন্তু শেখ হাসিনার বক্তব্যে কোন তথ্য দেখতে পেলাম না। তারেক রহমানের সেদিনের বক্তব্যের একটি শব্দও তথ্যের বাইরে ছিল না। কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি তারেক রহমান। কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তথ্যের জবাব তথ্য দিয়ে হওয়া উচিত।
তত্কালীন আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পত্রিকার শিরোনাম এবং প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন তারেক রহমান। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে রাজনৈতিক ফাঁকা বুলি নয়, এরকম তথ্য প্রমাণ দিয়ে সঠিক ইতিহাস জানান। তারেক রহমানের উপস্থাপিত বিকৃত ইতিহাসের বিপরীতে দালিলিক প্রমাণ সহ সঠিক ইতিহাস দেখতে চাই।
এখানে আরেকটি বিষয় বলে রাখা ভালো। তারেক রহমান তত্কালীন ইত্তেফাকে প্রকাশিত তথ্য উপস্থান যদি বিকৃত হয় সেটারও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। হয় ইত্তেফাক তখন বিকৃত তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশন করেছে। নতুবা তারেক রহমান ইত্তেফাকের কোন তথ্য বিকৃত উপস্থাপন করেছেন। তারেক রহমান ইত্তেফাকের তথ্য বিকৃত করে থাকলে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ইত্তেফাকের মালিক। ইত্তেফাকের তথ্য বিকৃত করে উপস্থাপনের অভিযোগে তিনি চাইলে তারেক রহামেরন বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হানিফ হাইকোর্ট দেখালেন। কথায় কথায় আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীরা হাইকোর্ট দেখান। মুক্তিযুদ্ধ হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে। ঘটনা প্রবাহের সাক্ষী হলো তত্কালীন গণমাধ্যম। তত্কালীন গণমাধ্যমে উঠে আসা ঘটনা প্রবাহ ইতিহাসের সাক্ষী। সেই সাক্ষ্য প্রমাণের আলোকে সঠিক ইতিহাস জানতে চাই আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে। তারেক রহমান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের পত্রিকা ইত্তেফাকের সাক্ষ্য প্রমাণ দেখিয়েছেন। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি আমাদের হাইকোর্ট দেখিয়ে লাভ নেই। সঠিক ইতিহাস দেখান। আমরা তখন তারেক রহমানের উপস্থাপিত ইত্তেফাকের বিকৃত তথ্য প্রমাণে বিশ্বাস করবো না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেই পত্রিকার তথ্য প্রমান উপস্থাপন করা হবে সেটাতে বিশ্বাস করবো।
লেখক : দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত।