ঐতিহাসিক বাস্তবতায় তারেক রহমানের বক্তব্য বিশ্লেষণ

ড. এম মুজিবুর রহমান

১. বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন তারেক রহমানের একটি বক্তব্য নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনার ঝড় বইছে। বাংলাদেশের ৪৩তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লন্ডনে একটি আলোচনা সভায় তারেক রহমান বলেছিলেন, জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং স্বাধীনতার ঘোষক। বাংলাদেশেও পৃথক সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ঢাকা মহানগর সভাপতি সাদেক হোসেন খোকা একই কথা বলেছেন। তবে তারেক রহমান ইতিহাসের এই সত্যটি সবার আগে বলায় এখন সমালোচকদের তীর তার দিকে। অনেকে বলেন, তারেক রহমান হঠাত্ করেই কেন এমন কথা বলেছেন। আসলে ভুলটা এখানেই। তারেক রহমানকে যারা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে তারেক রহমান সারাদেশে নিজ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন। তাদের নিয়ে তৃণমূল সম্মেলন করেছেন। এইসব তৃণমূল সম্মেলন আরো আট-দশটি রাজনৈতিক সম্মেলনের মতো ছিল না। এইসব সম্মেলনে তারেক রহমান একাই বক্তৃতা দেননি। দিনভর তুণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বক্তৃতা করেছেন। তারপর নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছেন তারেক রহমান। তবে এই বক্তৃতা দেয়ার আগে নেতাকর্মীদের প্রস্তুুতি নিতে হয়েছে।

প্রতিটি সম্মেলনের এক মাস আগে তারেক রহমান তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে ১৮টি প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রথম প্রশ্নটিই ছিল‘আপনি কেন বিএনপি করেন।’ এই প্রশ্নটি থেকেই তারেক রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তারেক রহমান নিঃসন্দেহে মনে করেন, একজন কেন বিএনপিকে সমর্থন করেন এটি তাকে জানতে হবে। যারা জেনে-বুঝে দল সমর্থন করবেন, তারাই দলের সম্পদ, দলের কাণ্ডারী। একটি দলে বিশেষ করে যেই দলটিকে মানুষ বারবার ক্ষমতায় দেখতে চায় এই দলে নানা মতের নানা চিন্তার মানুষের সম্মিলন ঘটে। এটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দলের সুখে-দুঃখে এমন একদল কর্মীবাহিনী থাকে, যারা সর্বাবস্থায়ই দলের পাশে থাকে, দলের স্বার্থে নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয় তৃণমূলে এমন একদল নেতা তৈরি করার কাজটি একযুগ আগে থেকেই শুরু করেছিলেন তারেক রহমান। যারা তারেক রহমানের এই দূরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তা বুঝতে পেরেছিলেন তারা গোড়া থেকেই তারেক রহমানের ইমেজ বিনষ্টের চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। অস্বীকার করার উপায় নেই এইসব নষ্ট প্রচারণার সঙ্গে হয়তো না বুঝেই সুর মিলিয়েছিলেন বিএনপিরই একাট সুবিধাবাদী চক্র।

২. তারেক রহমানের ঘোষণার পর নানা রকম আলোচনা চলছে। তারেক রহমানের এই তথ্যের সত্যতা বিচার হবে ইতিহাসের আলোকে। যে সম্মেলনে তারেক রহমান দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে এই তথ্যটি উপস্থাপন করেছেন, সেখানে তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন এর বিপরীতে কোনো দলিল প্রমাণ থাকলে সেটি উপস্থাপন করার জন্য। অথচ দেখা গেল, দলিল প্রমাণ নয়, লাঠি হাতে মাঠে নামিয়ে দেয়া হলো যুবলীগকে। ব্যাংক ডাকাতি কিংবা টেন্ডারবাজির ইতিহাস হলে সেখানে যুবলীগের লাঠিসোটা মানায়। কিন্তু তারেক রহমান উপস্থাপন করেছেন ঐতিহাসিক তথ্য। এখানে যুবলীগের কিছু করার নেই। নারী নির্যাতন, হল দখল, গোরস্থান দখল, ব্যাংক ডাকাতি, লুটতরাজ, টেন্ডারবাজি আর জঙ্গিবাদ এসব হলো যুবলীগের ইতিহাস। অপ্রিয় হলেও সত্য, যুবলীগের এই লাঠি বাহিনীর কারণেই প্রকৃত ও সত্য ইতিহাস নিয়ে স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও প্রশ্ন তুলতে হয়। তারেক রহমানের বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাসীন সরকারের এমন কিছু লোক কোনো প্রকার যুক্তিবুদ্ধি ছাড়াই যুবলীগের লাঠিয়াল বাাহনীর সর্দার হিসেবে মাঠে নেমেছেন যাদের অতীত প্রশ্নবিদ্ধ। শেখ মুজিবের এককালের কঠিন শত্রু যারা তার চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানাতে চেয়েছিলের সেই ইনু-মতিয়া এখন শেখ হাসিনার চেয়েও শেখ মুজিবের বড় ভক্ত। এরা ইতিহাসের সত্য প্রমাণের পরিবর্তে হুমকি-ধমকি শুরু করেছেন। আসলে যারাই স্বাধীনতার পর থেকে ইতিহাস লেখায় মনোনিবেশ করেছেন, তাদের কাউকে কাউকে সর্বদা তাড়িয়ে বেড়িয়েছে যুবলীগের লাঠি। ইতিহাস রচনাকারীদের কেউ কেউ আবার করাচি কিংবা কলকাতা ফেরত বুদ্ধিজীবী অথবা হানাদারদের মুরগি সাপ্লাইকারী মুক্তিযোদ্ধাদের গোত্রভুক্ত যারা নিজেদের পাপ ঢাকতে পোপের চেয়েও বড় ক্যাথলিক। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে হাফেজ হাকিম আজিজুল হকের পয়গাম পত্রিকার হকার কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলে পাকিস্তান সরকারের কর্মচারীদের ভাই-ভাতিজাদের পাপ মোচনের উদ্দেশ্যমূলক ইতিহাস রচনার প্রভাব বলয়ের বাইরে এসে কিছু মানুষের কলমে কিছু ইতিহাস উঠে এসেছে।

৩. ইতিহাসের আলোকে এবার দেখে নেয়া যাক তারেক রহমানের এই বক্তব্যের ঐতিহাসিক ভিত্তি কি? আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে যে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এটি সত্য বটে, তবে একই সঙ্গে এটিও সমান সত্য যে, এটি ছিল জিয়াউর রহমানের দ্বিতীয় ঘোষণা। তাহলে প্রথম ঘোষণাটি কি ছিল? সেটি কেন আমরা ভুলে যেতে বসেছি?
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতেই। শুরুতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন মেজর জিয়া। শুধু বিদ্রোহ ঘোষণাই করেননি, নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘোষণাটিও পাঠ করেছিলেন ২৬ মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ডে বর্ণিত জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটি এভাবে উল্লেখ আছে।
“Dear fellow freedom fighters, I, Major Ziaur Rahman, Provisional President and Commander-in-Chief of Liberation Army do hereby proclaim independence of Bangladesh and appeal for joining our liberation struggle, Bangladesh is independent. We have waged war for liberation war with whatever we have. We will have to fight and liberate the country from occupation of Pakistan Army. Inshallah, victory is ours.
সেই দুঃসময়ে বাঙালি জাতি ছিল দিশেহারা, দিকনির্দেশনাহীন। ঠিক এ সময়ে মেজর জিয়ার প্রত্যয়দীপ্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠের ঘোষণা ছিল তুর্যধ্বনির মতো। প্রথম ঘোষণায় তিনি নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন। তার এ ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ ভারতের ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের দলিলেও এটি রয়েছে।
প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক সচিব মঈদুল হাসান তরফদার লিখেন, ‘২৭ মার্চ সন্ধ্যায় ৮-ইবির বিদ্রোহী নেতা মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। মেজর জিয়া তার প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে ’রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শক্রমে তিনি শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন।’ (মূলধারা : ৭১, পৃষ্ঠা ৫)। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মেজর জিয়া শেখ মুজিবের নির্দেশে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা বললেও নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আগেকার ঘোষণা সংশোধন করেননি।
মেজর রফিক-উল-ইসলাম বীর উত্তম, মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার (১১ জুন থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) তার লেখা A Tale of millions গ্রন্থের ১০৫-১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ২৭ মার্চের বিকালে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। প্রথমে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে ঘোষণা করেন। পরে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। কেন তিনি মত পরিবর্তন করেন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মেজর রফিক-উল ইসলাম। একজন সামরিক কর্মকর্তা নিজেকে রাষ্টপ্রধানরূপে ঘোষণা দিলে এই আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র (polical character of the movement ) ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে এবং স্বাধীনতার জন্য এই গণ-অভ্যুত্থান সামরিক অভ্যুত্থান রূপে চিত্রিত হতে পারে, এই ভাবনায় মেজর জিয় পুনরায় ঘোষনা দেন শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে। এই ঘোষণা শোনা যায় ২৮ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত্ম। (RafiO-ul-Islam, A Tale of millions, Dhaka. BBI, ১৯৮১)। ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর কে এম সফিউলস্নাহ বীরউত্তম, তাঁর Bangladesh at war (Dhaka Academy Publishers, 1989) গ্রন্থে , ৪৩-৪৫ পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন : মেজর জিয়া ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তার কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও অন্যদের প্রথমে গ্রেফতার এবং পরে হত্যা করে, পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে ২৬ মার্চে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মোকাবিলার জন্য সবাইকে আহ্বান করেন। এই ঘোষণায় তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে ঘোষণা করেন।
মেজর কে এম সফিউল্লাহ আরো লিখেন, জিয়াউর রহমান তার ঘোষণায় আরো বলেন, ‘আমরা বিড়াল-কুকুরের মতো মরব না, বরং বাংলা মায়ের যোগ্য সন্তানরূপে (স্বাধীনতার জন্য) প্রাণ দেব। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং গোটা পুলিশ বাহিনী চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, যশোর, বরিশাল, খুলনায় অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকদের ঘিরে ফেলেছে। ভয়ঙ্কর যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। মেজর সফিউল্লাহর মতে, এই ঘোষণা দেশে এবং বিদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্দীপ্ত করে। যারা ব্যক্তিগত ও বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধে রত ছিলেন এই ঘোষণা তাদের নৈতিক বল ও সাহসকে বহুগুণ বাড়িয়েছে। অন্যরাও এই যুদ্ধে শামিল হন।
মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া লিখেছেন, জিয়াউর রহমান নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু পরে আরেকটি ঘোষণা দেন যে, এটা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে। এছাড়াও ড. আজিজুর রহমান, এম আর সিদ্দিকী, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম এবং অন্য আরো অনেকেই তাদের লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, জিয়া প্রথম দিনের ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন।
কর্নেল অলি আহমদ, বীর বিক্রম, অক্সফোর্ড বুকস বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের অনুবাদ গ্রন্থে রাষ্ট্র বিপ্লব : সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (ঢাকা, অন্বেষা প্রকাশন, ২০০৮) বলেছেন, মেজর জিয়া ছিলেন আমাদের নেতা এবং বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি (মুখবন্ধ)। সেই ঐতিহাসিক ঘোষণার সময় তিনি মেজর জিয়ার সঙ্গেই ছিলেন।
জিয়া একাত্তরের ২৬ মার্চ রাত ৭টা ৪৫ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গররত অবস্থায় একটি জাপানি জাহাজ থেকে অস্ট্রেলিয়া রেডিওতে জিয়ার ঘোষণার বার্তাটি পাঠানো হয়। অস্ট্রেলিয়া রেডিও জিয়ার ঘোষণাটি প্রথম প্রচার করে। এরপর বিবিসিতে প্রচারিত হওয়ার পর তা পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ গ্রন্থে দেয়া সাক্ষাত্কারে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বলেন, মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথম যে ঘোষণাটি দিলেন, সে ঘোষণায় তিনি নিজেকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বেতারের একজন শব্দসৈনিক বেলাল মোহাম্মদ। সেই সন্ধ্যার ঘটনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘জিয়াউর রহমান যে খসড়াটি তৈরি করেছিলেন তাতে তিনি নিজেকে প্রভিশনাল হেড অব বাংলাদেশ বলে উল্লেখ করেছিলেন। খসড়াটি নিয়ে তার সঙ্গী ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে আলোচনার সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম। মেজর জিয়াউর রহমান আমার মতামতও চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আপনার মতো আর কেউ আছে কি-না, মানে সিনিয়র অফিসার তা জানার উপায় নেই। বিদেশের কাছে গুরুত্ব পাওয়ার জন্য আপনি নিজেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সামরিক বাহিনীর প্রধান অবশ্যই বলতে পারেন। ঘোষণাটি প্রচারের সময় ‘বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে’ শব্দগুলো উল্লেখ করা হয়নি। বেলাল মোহাম্মদ আরো লিখেছেন, একটি এক্সারসাইজ খাতার পাতায় জিয়াউর রহমান এই ভাষণটি লিখেছিলেন।

৪. পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন, ৬ দফা আন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন ইতিহাসের এই সবক’টি বাঁকে শেখ মুজিবের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের ভূমিকা এবং কী ছিল মেজর জিয়াউর রহমানের ভূমিকা এটি আলোচনার দাবি রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গোলাম আযমই প্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য জিন্নাহর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। এটি ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা থাকার কারণে ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকাকে কালিমালিপ্ত করেছে। একইভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের ভূমিকা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। শেখ মুজিব ওই সময় স্বাধীনতার ‘৭১-এর মার্চ মাসে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুুত ছিলেন কি-না এটা গবেষণার বিষয়। শেখ মুজিব চেয়েছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতা হিসেবে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়ার পর ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন শেখ মুজিব। এটাই ইতিহাস।
এসব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবেই প্রথমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই ইতিহাস মানতে অসুবিধা কোথায়? ইতিহাসে শর্টকাট বলতে কিছু নেই। তারেক রহমান শুধু ইতিহাসের সত্য ঘটনাগুলোই মনে করে দিয়েছেন। ইতিহাস ঘটমান, চলমান, বহমান। কারো আপত্তি থাকলে এটি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হতে পারে। কিন্তু হুমকি-ধমকি বড়ই বেমানান। আর যারা বিএনপির নেতাকর্মী, তাদের জন্য ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি ফেরানোর জন্য তারেক রহমানের এই আহ্বান অবশ্যই ইতিবাচক একটি দিক বলেই আমি মনে করি। কারণ যারা বিএনপি করবেন তাদের অবশ্যই বিএনপির আদর্শেই উদ্বুদ্ধ হতে হবে। তারেক রহমানের এই অপ্রিয় সত্য বরং একটি বিষয়ের দিকে দিকনির্দেশ করে ‘বুকে শেখ মুজিব, মুখে বিএনপি এই দিন শেষ, জানতে হবে মানতে হবে জিয়ার বাংলাদেশ।’

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহ জালাল (রহ.) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2014/04/06/240620#.U1RiAl56YpE

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *