আদালতের রায় শিরোধার্য। আদালত যে রায় দেন তাই মেনে নিতে হয়। আদালতের রায় মানে তো বিচারকের হুকুম। যা মেনে চলা বাধ্যতামূলক। কথায় বলে হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। আদালতের রায়েরও নড়চড় হয় না। তবে আপিল করার সুযোগ থাকে। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে যে রায় মাননীয় আদালত দিয়েছেন সে ব্যাপারেও আপিল হয়েছে। জানি না এ আপিলে কী হবে।
স্বাধীনতার ঘোষক সম্পর্কে মাননীয় আদালত যে রায় দিয়েছেন, তাতে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট ট্রান্সমিটিং কেন্দ্র থেকে দেয়া জিয়াউর রহমানের ঘোষণা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। সংবাদপত্রে রায়ের যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে তাতে এ ব্যাপারে কিছু পাওয়া গেল না। বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ ভোরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং সে ঘোষণা সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছিল।
অথচ ইতিহাস বলে, ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিলেন। তাকে পাকিস্তানিরা গ্রেফতার করে করাচি নিয়ে গিয়েছিল। করাচি বিমানবন্দরে পুলিশ প্রহরায় তার বসে থাকা একটি ছবিও সে সময় পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। রায়ে বলা হয়নি, ‘২৬ মার্চ ভোরে’ দেয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি কি ছিল। কেমন করেই বা ২৫ মার্চের সেই বিক্ষুব্ধ রাতে তিনি এ ঘোষণা দিয়েছিলেন আর কেমন করেই বা সে ঘোষণা দেশের সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসে কখনো শোনা যায়নি। স্বাধীন বাংলা বেতারে কি তা একবারও প্রচার করা হয়েছে? ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর আম্রকাননে স্বাধীন বাংলার অস্হায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও তো সে ঘোষণা পাঠ করা হয়নি।
আদালতের রায় অনুযায়ী জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। তাহলে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি কি বলেছিলেন? আর সেই সন্ধ্যায় আমরাই বা কি শুনেছিলাম? একটি রায়ে আমাদের সব কিছু কি মিথ্যা হয়ে গেল? মিথ্যা হয়ে গেল আমার সেই আবদুল্লাহপুরের স্মৃতি, জিঞ্জিরা থেকে আরো অনেকটা পথ এগিয়ে যে গ্রামে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আমি, আমার মতো আরো কয়েকজন এবং গ্রামের আরো মানুষেরা নিজেদের কানে শুনেছিলাম জিয়াউর রহমানের ঘোষণা। স্বাধীনতার এই দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছরে জিয়াউর রহমানের এই ঘোষণার সত্যতা তো কাউকে অস্বীকার করতে শুনিনি। তবে বিতর্ক তোলা হয়েছে। বিতর্ক উঠেছে তার ঘোষণাটিই স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে কি না তা নিয়ে। বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুই ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন। বলা হয়েছে জিয়া ঘোষণা দিয়েছিলেন তবে তা ছিল বঙ্গবন্ধুর নামে, তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পাঠক ছিলেন মাত্র। এ সবই বলা হয়েছে রাজনীতির স্বার্থে। কিন্তু কেউ বলেননি জিয়া কোনো ঘোষণাই দেননি। রায়ে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত জিয়াউর রহমানের ‘একটি জাতির জন্ম’ লেখাটির উল্লেখ করে তার সততার প্রশংসা করা হয়েছে এবং এতে বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান এই লেখায় কোথাও বলেননি তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। মাননীয় বিচারপতি মহোদয়রা কি লক্ষ্য করেননি জিয়াউর রহমানের এই লেখাটি শেষ হয়েছে ২৬ মার্চ রাতে তার বিদ্রোহ ঘোষণার ঘটনার মধ্য দিয়ে। লেখাটির শেষ তিনটি লাইন হচ্ছে, ‘তখন রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল। রক্ত আখরে বাঙালির হৃদয়ে লেখা একটি দিন। বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন স্মরণে রাখবে এই দিনটিকে। স্মরণে রাখবে, ভালবাসবে। এই দিনটিকে কোনোদিন তারা ভুলবে না। কো-ন-দি-ন না।’
এই লেখায় ২৭ মার্চের কথা আসেনি। তাই ২৭ মার্চে দেয়া তার ঘোষণার কথাও আসেনি। মাননীয় বিচারপতি মহোদয়রা ১৯৭২-এর ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এই লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন অথচ এই একই সংখ্যা পত্রিকার প্রায় পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে সেটি কেমন করে তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল? এই সাক্ষাৎকারে তো তিনি বিস্তারিত বলেছেন কেমন করে তিনি কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এটিই ছিল পত্রিকার পাতায় জিয়াউর রহমানের প্রথম সাক্ষাৎকার এবং এ কথা বলতে আমি পেশাগত কারণেই গৌরব বোধ করি যে সে সাক্ষাৎকারটি আমারই নেয়া ছিল। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আমাকেই এসাইনমেন্ট দিয়ে কুমিল্লায় পাঠিয়েছিলেন এই সাক্ষাৎকারটি নেয়ার জন্য। জিয়া তখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাই, ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ এই সাক্ষাৎকার যখন প্রকাশিত হয় তখন বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। তখন কেউ এই সাক্ষাৎকার বা সাক্ষাৎকারের তথ্যাবলীর বিরুদ্ধে কোন কথা বলেননি, কালুরঘাট থেকে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া নিয়ে কেউ কোনো বিতর্ক তোলেননি। বরং এর পক্ষেই সবাই তখন কথা বলেছেন।
তখন যেমন কেউ বলেননি, এর অনেক পরেও জিয়ার ঘোষণা নিয়ে আজকের মতো এমন পরিস্হিতির সৃষ্টি করা হয়নি। এমনকি ১৯৮৭ সালেও ৪ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক মেঘনায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের মুখ থেকে শুনতে পাই, ‘২৭ মার্চ সকালে চায়না বিল্ডিং-এর কাছে আমার বন্ধু আতিয়ারের বাসায় গেলাম। তার কাছ থেকে একটা লুঙ্গি আর একটা হাফ শার্ট নিয়ে রওনা হলাম নদীর ওপারে জিঞ্জিরায়। নদী পার হয়েই রওনা হলাম গগনদের বাড়িতে। পথে দেখা হলো সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে। পরে আরো অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে এক লোক, তার ঘাড়ে ইয়া বড় এক ট্রানজিস্টর। আমরা যাব বালাদিয়া। নৌকায় শুনলাম হঠাৎ কোনো বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হচ্ছে আই মেজর জিয়াউর রহমান ডিক্লেয়ার ইন্ডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ। আমরা তো অবাক। বলে কি? পরে আবার শুনেছি জিয়া বলছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’ মেঘনায় প্রকাশিত আবদুর রাজ্জাকের এই সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম ছিল, ‘বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস প্রস্তাব বিবেচনা করছিলেন।’
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, এদেশের প্রায় প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা যার রয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বইয়ে লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একজন বাঙালি মেজরের ঘোষণায় পুরো জাতি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জেগে ওঠে।’
এসব বক্তব্যের সঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে স্বাধীন বাংলা বেতারের সেসব কর্মীদের কথা, যারা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এদের একজন বেলাল মোহাম্মদ। সেই সন্ধ্যার ঘটনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘জিয়াউর রহমান যে খসড়াটি তৈরি করেছিলেন তাতে তিনি নিজেকে প্রভিশনাল হেড অব বাংলাদেশ বলে উল্লেখ করেছিলেন। খসড়াটি নিয়ে তার সঙ্গী ক্যাপ্টেটনদের সঙ্গে আলোচনার সময় আমিও উপস্হিত ছিলাম। মেজর জিয়াউর রহমান দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন-এ ঘোষণা প্রচার করা সঙ্গত হবে কিনা। একজন বললেন, এ প্রাধান্য আপনাকে দাবি করতেই হবে। নইলে দেশ-বিদেশের কাছে আপনার আবেদনের গুরুত্ব কি করে হবে? জিয়া বলেছিলেন, কিন্তু অন্য এলাকায় আমার চেয়ে সিনিয়র বাঙালি অফিসার থাকতে পারেন। তিনিও হয়তো আমাদের মতোই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন এবং প্রতিরোধ করছেন। মেজর জিয়াউর রহমান আমার মতামতও চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, ক্যান্টনেমেন্টের বাইরে আপনার মতো আর কেউ আছে কিনা মানে সিনিয়র অফিসার তা জানার উপায় নেই। বিদেশের কাছে গুরুত্ব পাওয়ার জন্য আপনি নিজেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সামরিক বাহিনীর প্রধান অবশ্যই বলতে পারেন। ঘোষণাটি প্রচারের সময় ‘বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে’ শব্দগুলো উল্লেখ করা হয়নি। বেলাল মোহাম্মদ আরো লিখেছেন, একটি এক্সারসাইজ খাতার পাতায় জিয়াউর রহমান এই ভাষণটি লিখেছিলেন। তার ঘোষণার ইংরেজি পান্ডুলিপি বেলাল মোহাম্মদের পকেটেই ছিল। তিনি তখন থাকতেন ডা. শফির বাসায়। বাসায় ফেরার পর তিনি সেটা ডা. শফিকে দেখতে দিয়েছিলেন। ডা. শফি বলেন, এসব কাগজ রাখতে নেই। প্রচার হয়ে গেছে, প্রয়োজন মিটে গেছে। বলেই ডাঃ শফি কাগজের টুকরোটি চুলার আগুনে ফেলে দিয়েছিলেন।
এ তথ্য নিশ্চয় কারো অজানা নয় যে জিয়াউর রহমানের এই প্রথম ঘোষণাটি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মহল মেনে নিতে পারেনি। প্রবীণ রাজনীতিক ও শিল্পপতি একে খান বলেছিলেন, এ ধরনের ঘোষণা বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। শেখ মুজিবের নামে যাতে ঘোষণা দেয়া হয় তিনি তার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এমনও মন্তব্য করেছিলেন যে, জিয়ার এই ঘোষণায় বহির্বিশ্বে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিান্তিকর পরিস্হিতিতে এ ধারণার সৃষ্টি হবে যে, এখানে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মল্লিকও জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণায় বঙ্গবন্ধুর নাম যোগ করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রণীত হয় জিয়ার দ্বিতীয় ঘোষণা। এই ঘোষণাটিও জিয়া নিজে পাঠ করেন। এই ভাষণেই তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের সহযোদ্ধা মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া লিখেছেন, ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় প্রথম দিনের ভাষণে জিয়াউর রহমান নিজেকে অস্হায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেই ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে বেতার ভাষণটি সংশোধন করে তিনি ঘোষণা দেন যে, এই মুক্তিযুদ্ধ তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে। শুধু জেনারেল ভূঁইয়াই নন, ড. আজিজুর রহমান, এম আর সিদ্দিকী, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম এবং অন্য আরো অনেকেই তাদের লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, জিয়া প্রথম দিনের ভাষণে অস্হায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন। পরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চাপে তিনি তার বক্তব্য সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন।
এত কথার অবতারণা শুধু এটুকু বলার জন্য যে, ২৭ মার্চ দেয়া জিয়ার ঘোষণাটি সর্বজনস্বীকৃত। ইতিহাসের এই সত্যকে মাননীয় আদালত বেমালুম অস্বীকার করে গেলেন কেমন করে? কেমন করে তারা বললেন জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।
বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় জিয়াকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে হবে-এ তো আমাদের দেশের রাজনীতির কথা। আদালতকে তো আমরা এই রাজনীতির ঊর্ধ্বে দেখতে চাই। আদালতের কাছে তো আমাদের প্রত্যাশা নিরপেক্ষ সুবিচারের।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম এবং একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের বিশাল সাফল্যে বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব তো কোনোদিন ম্লান করে দেয়া যাবে না। এ প্রয়াস যারা চালাবে, তারা নিজেরাই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে; বলাবাহুল্য, ইতোমধ্যে অনেকেই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে এবং তাকে সামনে রেখেই যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে-এ কথা কে অস্বীকার করতে পারে? কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তাকে শ্রেষ্ঠ করতে গিয়ে অন্যদের খাটো করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে যার যা অবদান তা অস্বীকার করা হবে। আর এর জন্য মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রতিষ্ঠা করা হবে।
রায়ে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ ভোরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আগেই বলেছি, ২৬ মার্চ ভোরে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়ে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। তাহলে কখন তিনি ঘোষণা দিলেন? বঙ্গবন্ধু নিজে কখনো তার স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। গ্রেফতারের আগে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে গেছেন কিনা, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও এ ধরনের কিছু কখনো প্রচার করা হয়নি। বিষয়টি প্রথম প্রচার পায় স্বাধীনতার পর। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘তারা (পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী) অতর্কিতে ২৫ মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করল। তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে, আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম।’ এই একই বছরের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় তিনি ২৫ মার্চের রাতের ঘটনা উল্লেখ করে আবার বলেন, ‘রাতে আমি চট্টগ্রামে নির্দেশ পাঠালাম। আগে যাকে ইপিআর বলা হতো তাদের সদর দফতর ছিল চট্টগ্রামে। পিলখানা হেডকোয়ার্টার্স তখন শত্রুরা দখল করে নিয়েছে। ওদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। আমি যখন পিলখানায় যোগাযোগ করতে পারলাম না, তখন আমি চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগ করে বললাম, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। তোমরা বাংলার সব জায়গায় ওয়্যারলেসে খবর দাও।’
চট্টগ্রামে খবর পাঠাবার কথা বলা হলেও কীভাবে তিনি তা পাঠিয়েছিলেন এবং কাকে পাঠিয়েছেন নির্দিষ্টভাবে তিনি তা উল্লেখ করেননি। তার বাসায় কোনো ওয়্যারলেস ছিল-এমন কথাও জানা যায় না। মনে রাখতে হবে, তখন খবর আদান-প্রদানের যোগাযোগ ব্যবস্হা আজকের মতো এত সহজ ছিল না। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে ‘২৫ মার্চ তারিখে আমি স্বাধীনতার ঘোষণা করলাম’ কথাটি উল্লেখ করলেও এর পরই তিনি ৭ মার্চের ভাষণের প্রসঙ্গে চলে যান। তিনি বলেন, ‘৭ মার্চ কি স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলা বাকি ছিল? প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চই স্বাধীনতা সংগ্রাম ঘোষণা করা হয়েছিল।’ শুধু একটি সমাবেশ নয়, তিনি পরেও বিভিন্ন স্হানে বলেছেন, ‘৭ মার্চই কি আমি বলি নাই এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম?’
২৫ মার্চের রাতের বদলে ৭ মার্চের ঘোষণার ওপর তার এই গুরুত্বারোপ এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়। প্রশ্ন উঠেছে তিনি বারবার কেন ৭ মার্চের ঘোষণার কথা উল্লেখ করেছেন? ২৫ মার্চ রাতের কিংবা আদালতের রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী ‘২৬ মার্চ ভোরের’ স্বাধীনতার ঘোষণার কথা নয় কেন? ওই রাতে তার স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া এবং তা চট্টগ্রাম প্রেরণের দাবিটি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি সেই বিভীষিকাময় রাতের পরিস্হিতির কারণে। সে রাতে তার পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মতো পরিস্হিতি কি তার বাড়িতে বিরাজ করছিল? কত রাতে এ ঘোষণাটি তৈরি করা হয়েছিল আর কীভাবেই বা তা চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছিল, তার কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলের উল্লেখ করা যেতে পারে। সে রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আনুপূর্বিক ঘটনা নিয়ে তার জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে ঘটনা’। এই বইতে কোথাও তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলেননি। আর একটি কথা। স্বাধীনতার পরে যখন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার তথ্য প্রকাশ পেতে লাগল, তখন একটি নয় দুটি ঘোষণার কথা জানা গেল। একটি সংক্ষিপ্ত আর একটি দীর্ঘ ও সুলিখিত। এই দ্বিতীয়টিই সংবিধানে স্হান পেয়েছে। সংক্ষিপ্ত ঘোষণাটি ছিল, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বাণী। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ যে যেখানে আছে এবং তাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীকে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তানের দখলদার সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় লাভ না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। জয় বাংলা।’
রায়ে ‘২৬ মার্চ ভোরে’ বঙ্গবন্ধুর যে ঘোষণার কথা বলা হয়েছে, সেটি কোন ঘোষণা? এই সংক্ষিপ্তটি না সংবিধানের অন্তর্ভুক্তটি? ইতিহাসের সত্যতার স্বার্থে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার।
নিউইয়র্ক, ২৩ জুন ’০৯